পূর্ব বাংলার সৃষ্টি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা পাওয়ার ইতিহাস

 

আমরা  স্বাধীন বাংলাদেশী। তবে আমরা জানি কি, কিভাবে আসলো আমাদের এই স্বাধীনতা? কেমন করে বা সৃষ্টি হলো আমাদের ভূখণ্ড? আমরা অনেকেই এর ইতিহাস জানিনা। তবে বাংলাদেশি বা বাঙালি হিসেবে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস জানা উচিত। কিভাবে আমাদের ভূখণ্ড সৃষ্টি হল তা জানা উচিত।

অখন্ড ভারত থেকে আমাদের জন্মের ইতিহাস

ব্রিটিশ শাসনের সময় ভারতবর্ষ ছিল বিশাল এক উপনিবেশ। এখানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সকল ধর্মের মানুষ একসাথে বসবাস করতো। তবে হিন্দু ও মুসলমান ছিল তুলনামূলক বেশি। ব্রিটিশ শাসকদের পতনের আচ লক্ষ্য করে মুসলমানরা বুঝতে পারে ভারত যদি অখন্ড থেকে যায়, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা মুসলমানদের উপর কর্তৃত্ব চালাবে। এসব আচ লক্ষ্য করে মুসলমানেরা আলাদা রাষ্ট্রের দাবী জানায়।

প্রথম পর্যায়ে এসব দাবির কোন ভিত্তি না থাকলেও, পরবর্তীতে আন্দোলনের ফলে ঠিকই ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তৎকালীন পূর্ব বাংলা অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ ছিল সেই পরিকল্পনার অংশ।

বাংলাদেশে অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষ মুসলমান হওয়ার কারণে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে স্বাধীনতা দেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশের পাশাপাশি বর্তমানে ভারতের হায়দ্রাবাদও স্বাধীন হিসেবে ঘোষিত হয়। তবে ভারত সরকার পরবর্তীতে হায়দ্রাবাদকে আবার দখল করে নেয় এবং ভারতের একটি প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করে।

১৯৪০ সালের দ্বি-জাতি তত্বের ঘোষনা

২৩ শে মার্চ ১৯৪০ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের অধিবেশন গৃহীত হয়। অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। সেই অধিবেশনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, ইন্ডিয়া বিশাল এক উপমহাদেশ এই উপমহাদেশে দুটি ধর্মের মানুষ বেশি তাই ধর্মের ভিত্তিতে এই উপমহাদেশকে ভেঙে দুটি রাষ্ট্রে পরিণত করা হোক।

এই ঘোষণার পর হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে রেষারেষি শুরু হয়ে যায়। তৎকালীন ভারতের সবচেয়ে সফল দল কংগ্রেস ভারতের নেতৃত্ব দিতে চাইলেও, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এই ঘোষণার পর মুসলমানরা তা মেনে নিতে রাজি ছিল না। মুসলমানেরা মনে করছিল, কংগ্রেস যদি ভারতের নেতৃত্ব দেয় তাহলে তাদের রাজনৈতিক অধিকার উপেক্ষিত হবে।

তাছাড়া মুসলমানদের সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস,তাদের সামাজিক রীতি-নীতির সঙ্গে হিন্দুদের বিশাল পার্থক্য ছিল এবং মুসলমানদের নিরাপত্তাও শঙ্কা ছিল। যদি ব্রিটিশরা ভারত থেকে চলে যায়, তাহলে ভারতের ক্ষমতা যাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের হাতে আর মুসলমানেরা চিরকাল বঞ্চিত থাকবে রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে। এই ভয় থেকে তারা দেশভাগের সিদ্ধান্ত নেয় এবং পরবর্তীতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয় আর পূর্ব বাংলা হয়ে যায় পাকিস্তানের একটি প্রদেশ।

ভারতের স্বাধীনতা এবং পাকিস্তানের স্বাধীনতা

পাকিস্তানের স্বাধীনতাঃ 

১৪ই আগস্ট ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়। ভারতের তৎকালীন দুটি বড় দল কংগ্রেস ও অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের মধ্যে মত বৈষম্য থাকায় ব্রিটিশ সরকার ভারত স্বাধীনতা আইন ১৯৪৭ পাস করে। পরবর্তীতে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয়। 

পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লিয়াকত আলী খান এবং পাকিস্তানের প্রধান গভর্নর ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।

ভারতের স্বাধীনতাঃ

ভারত ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা অর্জন করে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর ধীরে ধীরে ভারত ব্রিটিশদের হাতে চলে যায় তারপর ব্রিটিশরা ২০০ বছর ভারতবর্ষ শাসন করে। নিরীহ ভারতীয়রা মুখ বুজে তা সহ্য করে নেয়। তবে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সারা দিয়ে সব ভারতীয়রা একজন হয় এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে। ভারতের স্বাধীনতা পাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজরা বিরাট ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে। পরবর্তীতে তাদের আর ভারতকে ধরে রাখার সামর্থ্য ছিল না। তাই পাকিস্তানের এক দিন পর ভারতকেও স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয় তারা। এভাবে ভারত তার স্বাধীনতা অর্জন করে। 

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন জওহরলাল নেহেরু এবং ভারতের প্রথম গভর্নর নিযুক্ত হন লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন।

পূর্ব বাংলার ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর পূর্ববাংলা পাকিস্তানের মধ্যে চলে যায়। পূর্ব বাংলাকেও শাসন করতে থাকে পাকিস্তান। তবে পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার বাঙালিদের অধিকারের অর্ধেকও দিত না। তাই প্রথম থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানিদের উপর পূর্ব পাকিস্তানের কোন শ্রদ্ধা ছিল না। তারা পূর্ব বাংলা থেকে লুটপাট করে যা পেতো সব পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ে যেত। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও বাঙ্গালীদের পিছিয়ে রেখেছিল তারা। কিন্তু নিরীহ বাঙালির কিছুই করার ছিল না। তারা সব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে নিচ্ছিল।

সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু ২১ মার্চ ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল সফরে এসে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। যা গোটা বাঙালি জাতিকে ক্ষিপ্র করে তোলে। তিনি বলেন উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তখন বাঙালির আর চুপ থাকেনি। যখন মায়ের ভাষার উপর আক্রমণ করা হয়, তখন থেকেই শুরু হয় যুদ্ধ। তখন থেকে বাঙালিরা পাকিস্তানীদের ঘৃণা করতে শুরু করে। তবে তাতে পাকিস্তানের তেমন কোন সমস্যা হয়নি। তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল, নিজেদের মত। তারা বুঝতে পারেনি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এই একটা ঘোষণা পরবর্তীতে বাঙ্গালীদের স্বাধীনতার চেতনা হয়ে উঠবে।

সময়টা ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। যখন পাকিস্তানের পার্লামেন্টে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হয় তখন নিরীহ বাঙালির আর মুখ বুজে থাকেনি। তারা ময়দানে নেমে পড়ে। শুরু করে জ্বালাময়ী আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা শুরু করে মায়ের ভাষা রক্ষা করার যুদ্ধ। এই যুদ্ধ থামাতে এসে পুলিশ গুলি চালালে গুলিতে সালাম, রফিক, বরকত সহ আরো নাম না জানা অনেকে মারা যায়। এই ঘটনা পুরো বাঙালি জাতিকে নাড়িয়ে দেয়। পুরো বাঙালি জাতি আন্দোলনের নেমে পড়ে। পরবর্তীতে ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়।









এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

জোবায়ের ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়

comment url