ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের ইতিহাস
যুগে যুগে অনেক মুসলিম শাসক ভারতবর্ষকে শাসন করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো মুঘল সাম্রাজ্য। মুঘলরা মোটামুটি ৩৩১ বছর ভারত শাসন করেছে। ১৫২৬ থেকে শুরু করে ১৮৫৭ পর্যন্ত শাসন করেছে। ব্রিটিশ শক্তি পুরোপুরিভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত ভারতবর্ষ মুঘলদের হাতে ছিল। যদি সে সময় ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে না আসতো তাহলে হয়তো এখন পর্যন্ত ভারতবর্ষ মুঘলদের হাতে থাকতো। এখনো পর্যন্ত তারা ভারত শাসন করতো।
মুঘল শাসনের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ বাবর
মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ বাবর। তার জন্ম ১৪ ফেব্রুয়ারি
১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে আন্দিজান, ফারগানা উপত্যকায়, বর্তমানে যেটা উজবেকিস্তান নামে
পরিচিত। তিনি মায়ের সূত্রে চেঙ্গিস খান ও বাবার সূত্রে তৈমুর লং এর উত্তরসূরী।
ছোটবেলা থেকে বাবর ছিল যুদ্ধবাজ এক শাসক। তিনি তার বাবার সূত্রে পাওয়া রাজ্য
মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে হারিয়ে ফেলেছিলেন। কারণ তিনি পাশের রাজ্যে আক্রমণ
করেছিলেন, নিজের রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধির আশায়। কিন্তু তিনি নির্মমভাবে পরাজিত
হন এবং নিজের রাজ্য হারিয়ে ফেলেন। পরবর্তীতে বাবরের চোখ যায় ভারতবর্ষের দিকে।
কারণ ভারতবর্ষের সেসময় ছিল সোনায় সোহাগা। তখন ভারতবর্ষ শাসন করছিল দিল্লি
সালতানাত। ভারতবর্ষ এতটাই সম্পদশালী ছিল যে, কিছুদিন পর পর ভারতবর্ষে আফগান
শাসকেরা আক্রমণ চালিয়ে লুট করে নিয়ে যেত। তাছাড়া ফসল ফলার দিক থেকে
ভারতবর্ষে ছিল সবার শীর্ষে। তাই অধিকাংশ শাসকদের চোখ ছিল ভারতবর্ষের দিকে।
কিন্তু ভারতবর্ষ আক্রমণ করে দখল করা এতটা সহজ ছিল না। কারণ ভারতবর্ষে তখন
স্থায়ী ভাবে দিল্লি সালতানাতের বড় বড় শাসকেরা শাসন করছিল।
মোহাম্মদ ঘুড়ির ভারত বিজয়ের পর মুসলিম শাসকদের অধীনে ভারতবর্ষ অনেক শক্তিশালী
হয়ে যায়। তাই ভারতবর্ষের দিকে চোখ দেওয়া কেবলমাত্র মূর্খামু। কিন্তু সম্রাট
বাবর ছিলেন একজন নির্ভীক যোদ্ধা। তিনি ছিলেন যুদ্দাবাজ চেঙ্গিস খান ও তৈমুর লং
এর উত্তরসূরী। তাই তিনি ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে আক্রমণ করে বসেন।
১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের পানিপথের যুদ্ধ
১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি সালতানাতের শেষ শাসক ইব্রাহিম লোদী ও উজবেকিস্তানের
শাসক জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ বাবরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে বাবর সর্বপ্রথম
কামানের ব্যবহার করেছিলেন। এটি ইতিহাসে পানিপথের যুদ্ধ নামে পরিচিত। পানিপথ
নামেক এক স্থানে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তাই এটিকে পানিপথের যুদ্ধ বলা হয়। এই
যুদ্ধে বাবর জয়ী হোন এবং ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের গুড়াপত্তন করেন।
এই যুদ্ধে বাবরের সেনাবাহিনীতে কেন সংখ্যা ছিল মাত্র ১২০০০ হাজার। কিন্তু এত কম
সেনা নিয়ে বাবর কিভাবে ভারতবর্ষে দখল করলো? কারন ছিল, বাবরের সেনাবাহিনীর
অধিকাংশ সেনা ছিল যুদ্ধবাজ, কৌশলী এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাছাড়া তিনি
ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম কামানের ব্যবহার করেছিলেন। তার বারো হাজার সৈন্যের মধ্যে
অশ্বারোহী ছিল ৯০০০ হাজার। পদাদিক বাহিনী ছিল ৩০০০ হাজার। অপরদিকে ইব্রাহিম
লোদীর সেনা সংখ্যা ছিল এক লক্ষ। কিন্তু তার অধিকাংশ সেনা ছিল অনভিজ্ঞ, যুদ্ধের
কথা শুনে সাধারণ জনগণকে যুদ্ধের ময়দানে শামিল করেছিল। কিন্তু ইব্রাহিম লোদী
পিছিয়ে ছিলাম এক জায়গায় সেটা হল কামান। আরে কামানের কারণে তিনি বাবর এর কাছে
হেরে যান।
শেষ পর্যন্ত পানিপথের যুদ্ধে তুর্কি সেনাদের সাহায্যে জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ বাবর
জয় লাভ করেন এবং ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের গোড়াপত্তন করেন। তাই মুঘলরা থাকে খুব
সম্মানের সাথে স্মরণ করে। তার প্রতিষ্ঠিত মুঘল সাম্রাজ্য ৩৩১ বছর ভারতবর্ষে
শাসন করে। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে ২৬ ডিসেম্বর ভারতের আগ্রয় মাত্র ৪৭ বছর বয়সে
মুঘল সম্রাট বাবর ইন্তেকাল করেন। তবে বাবরের মৃত্যু নিয়ে একটা গল্প প্রচলিত
আছে। বাবরের পুত্র হুমায়ুন যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তখন বাবর আল্লাহর কাছে
দোয়া করেছিলেন, হে আল্লাহ তুমি আমার সন্তান হুমায়ুন কে সুস্থ করে দাও এবং
আমাকে নিয়ে নাও, আমার হায়াত তুমি আমার সন্তানকে দান করো। তারপর সম্রাট বাবর
মৃত্যুবরণ করেন।
মুঘলদের দ্বিতীয় সম্রাট নাসিরউদ্দিন মোহাম্মদ হুমায়ুন
১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে বাবা জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ বাবরের মৃত্যুর পর মাত্র ২৩ বছর বয়সে মুঘল সিংহাসনে বসেন নাসিরউদ্দিন মোহাম্মদ হুমায়ুন। তিনি ৬ মার্চ ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদী বেগমের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তার চরিত্র ছিল খুবই ভালো। তিনি খুব ভালো মনের মানুষ ছিলেন। তবে তিনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমালোচিত হয়েছেন তার দুর্বল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে। তাছাড়া তিনি মুঘলদের ইতিহাসের খুবই ভালো একজন শাসক। তাছাড়া শিক্ষাগত দিক বলতে গেলে হুমায়ুন বিজ্ঞান, জ্যোতিষশাস্ত্র ও সাহিত্যের প্রতি প্রবল আগ্রহী ছিলেন। তাই তিনি বিশাল এক গ্রন্থাগার তৈরি করেছিলেন।
তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি সমালোচিত। বিশেষ করে তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে। যার কারণে শেরশাহের কাছে তিনি একবার সিংহাসন হারিয়েছিলেন। যদিও পরবর্তীতে তিনি তা আবার ফেরত পান যুদ্ধ করে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন রাজনীতির ক্ষেত্রে হুমায়ুন কখনোই যোগ্য ছিলেন না। তবে তার সময়ে কোন অন্যায় অত্যাচার হত না। তিনি আল্লাহ ভীরু শাসক ছিলেন।
২৭ শে জানুয়ারি ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের এক দুর্গে লাইব্রেরীর সিঁড়ির উপরে বই পড়ছিলেন হুমায়ুন। হঠাৎ তিনি পা পিছলে পড়ে যান এবং খুবই গুরুতর আঘাত পান। পরবর্তীতে এই আঘাতের কারণে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে মুঘলদের দ্বিতীয় সম্রাট ইন্তেকাল করেন।
মুঘলদের তৃতীয় সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর
বাবা হুমায়ুনের মৃত্যুর পর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৩ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন আকবর দা গ্রেট। তিনি ১৫ই অক্টোবর ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন মুঘলদের সবচেয়ে সফল সম্রাট। পিতা হুমায়ুনের অকাল মৃত্যুতে মাত্র ১৩ বছর বয়সে তাকে মুঘল সিংহাসনে বসতে হয়। কিন্তু কে জানতো এই আকবরই হয়ে যাবে, মুঘলদের সবচেয়ে সেরা সম্রাট। তাকে মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাশীল ও সফল সম্রাট হিসেবে দেখা হয়। তবে লোকের বলা কথাতে নয়, তার কার্যক্রম তার ইতিহাস শৈলী, শিল্পকর্ম তাকে এই অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তার সময়ে ভারতবর্ষের প্রত্যেকটা রাজাকে বস্যতা স্বীকার করানো হয়।
ছোটবেলা থেকেই আকবর ছেলে অত্যন্ত মেধাবী। তিনি পড়াশোনা করতেন ছোটবেলা থেকেই, ইসলামের ধর্মীয় শিক্ষা, জ্যোতিবিদ্যা, সাহিত্য ও ইতিহাস ইত্যাদির উপরে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন এবং তার শিক্ষক ছিলেন মুসলিম পন্ডিত ও তুর্কি শিক্ষক। তার সমেয়ে ভারতবর্ষে শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল সবচেয়ে সফল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সংস্কৃতিমনা। তার সময়ে স্থাপত্যশৈলীর মধ্যে ছিল মসজিদ মন্দির আরো অনেক ধর্মীয় দালান।
জোবায়ের ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়
comment url