বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়
রাষ্ট্র হিসেবে বাংলার রয়েছেন সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও ইতিহাস। প্রাচীনকাল থেকে এর নানা অঞ্চলে প্রয়োজন অনুসারে গড়ে উঠেছিল অনেক জনপদ। মৌয ও গুপ্তযুগ পেরিয়ে বাংলার প্রথম স্বাধীন শাসক শশাঙ্ক কর্তৃক বাংলা শাসনের সূত্রপাত ঘটলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তারপর অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পাল শাসনের সূত্রপাত হয়। একাদশ শতাব্দীর মাঝের দিকে পাল শাসকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাংলায় সেন শাসনের সূত্রপাত ঘটে। ১৩ শতকের দিকে সেন শাসকদের পরাজিত করে, ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাত ঘটায়।
মুসলমানরা আগমনের পূর্বে বাংলার সামাজিক অবস্থা
মুসলমানরা আগমনের পূর্বে বাংলায় হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের মানুষের সংখ্যা বেশি ছিল।
তখন বাংলায় জাতিভেদ খুব করা ছিল। অর্থাৎ বাংলায় তখন বিভিন্ন জাতের লোক বসবাস
করত। ব্রাহ্মণ শ্রেণীরা ছিল সমাজের সবচেয়ে উঁচু জাত বা সম্মানিত জাত। সাধারণ
মানুষ ছিল সমাজের নিচু জাত। বাংলায় সে সময় নারীরা গৃহবন্দী জীবন যাপন করত। বলতে
গেলে নারীর কোন স্বাধীনতা ছিল না। শিক্ষার অধিকার ছিল না বললেই চলে। বহুবিবাহ
প্রচলিত ছিল কিন্তু বিধবা বিবাহ সম্পন্ন নিষেধ ছিল।
তখন হিন্দু ও বৌদ্ধ বিদ্যাপীঠ গুলোতে শিক্ষা দেওয়া হতো। তবে সাধারণ মানুষ
শিক্ষার সুযোগ পেতো না। শিক্ষা কেবলমাত্র উঁচু জাতের লোকদের জন্য বরাদ্দ ছিল।
সে সময় সংস্কৃত ও পালি ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হতো। সেই সময় অধিকাংশ মানুষের
পেশা ছিল কৃষিকাজ। বাংলার সাধারণ মানুষ কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত। কিছু
মানুষ কারিগর, তাতি ও ব্যবসায়ীও ছিল। উচ্চবর্ণের লোকেরা ধর্মীয় নেতা ও জমিদার
হিসেবে সমাজের চলাফেরা করত।
সমাজের অধিকাংশ মানুষের মনে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার ছিল। সে সময় নিম্ন বর্ণের
মানুষের উপর অমানবিক আচরণ করা হতো। সাধারণ মানুষের কোন মূল্য ছিল না। উচ্চ
শ্রেণীর মানুষেরা যা বলতো তাই করা লাগতো। এক কথায় কোন স্বাধীনতা ছিল না।
বাংলার সাধারণ মানুষ তখন বর্বর ও নির্যাতনের যুগ পার করেছিল।
আরো পড়ুনঃ ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের ইতিহাস
বাংলার প্রথম স্বাধীন শাসক শশাঙ্ক
গুপ্ত শাসনের পতনের পর ৬০৬ থেকে ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার খন্ড খন্ড রাজ্যগুলিকে
একত্রিত করে বাংলাকে একটি একক শক্তিশালী রাষ্ট্রের গড়ে তোলেন শশাঙ্ক। তখন
বাংলার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণ গ্রাম।
শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাংলায় মহা দুরদিন নেমে আসে। হর্ষবর্ধন ও ভাস্কর বর্মনের
হাতে একদিকে বিশাল গৌড় রাজ্য ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় অন্যদিকে ক্ষমতাশালী
ভূস্বামীরা একে অন্যের সাথে সংঘাতে মেতে ওঠে।
কেন্দ্রীয় শাসন না থাকায় সমস্ত শাসকেরা যে যার মত চারিদিকে জবরদখল করতে থাকে।
বাংলার এরূপ নৈরাজ্যময় যুগ প্রায় ১০০ বছর স্থায়ী ছিল।
বাংলার পাল যুগ
শশাঙ্কর পরবর্তী ১০০ বছর শোষিত হওয়া বাঙালিদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। তারা
আন্দোলন শুরু করে। বাংলার সব মানুষ এক হয়ে গোপাল নামে এক লোককে বাংলার রাজা
নির্বাচন করে। সেই ব্যক্তির প্রচেষ্টায় বাংলায় আবার নবযুগ শুরু হয়।
গোপালের পর তার পুত্র ধর্মপাল বাংলার সিংহাসনে বসেন। ধর্মপাল ছিলেন পাল বংশের
শ্রেষ্ঠ রাজা। দশম শতাব্দীতে পাল বংশের গৌরব মাটিতে নেমে আসে।
পশ্চিম বাংলায় ভিম নেতারা কিছু সময়ের জন্য ক্ষমতা দখল করে নেয়। পাল বংশের
শেষ রাজা রামপাল আবার পাল বংশ পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু তিনি পাল বংশের হারানো
গৌরব পুনরুদ্ধার করতে সফল হননি। ফলে তার মৃত্যুর পর পাল শাসন আরো দুর্বল হয়ে
পড়ে। পালদের এই দুর্বল শাসনের সুযোগ নিয়ে সেনরা বাংলায় নতুন সাম্রাজ্য
প্রতিষ্ঠা করে।
বাংলায় সেন শাসনের যুগ
পাল রাজাদের দুর্বলতার সুযোগে বাংলার ব্যাপক অংশে সেন রাজাদের শাসনের
অন্তর্ভুক্ত হয়। সেনদের আদি নিবাস ছিল ভারতের কর্ণাট জেলায়। সেন বংশের
প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বাংলায় সামন্ত সেনের নাম পাওয়া যায়। তবে বিজয় সেন ছিলেন
এ বংশের প্রথম রাজা।
তারপর সেন বংশের রাজা হন বল্লব সেন। বল্লব সেনের মৃত্যুর পর তার পুত্র লক্ষণ
সেন পিতার রেখে যাওয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন
হিন্দু রাজা। তার রাজত্বের শেষ দিকে সেন রাজ্য অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সুযোগে
চারদিকে শাসকেরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
সেন বংশের পতনের মূল কারণ ছিল, বাংলার শেষ রাজা লক্ষণ সেনের দায়িত্বহীন শাসন।
তিনি ক্ষমতায় বসার পর থেকে বাংলার সুরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। তার রাজমহলের
শুরু হয় তার সমালোচনা। তিনি অধিকাংশ সময়ই মদ্যপান ও নারী আসক্তিতে থাকতেন।
যার কারনে শেষ পর্যন্ত বাংলায় সেন শাসনের পতন ঘটে।
সেন বংশের পতনের মূল কারণ ছিল, বাংলার শেষ রাজা লক্ষণ সেনের দায়িত্বহীন শাসন।
তিনি ক্ষমতায় বসার পর থেকে বাংলার সুরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। তার রাজমহলের
শুরু হয় তার সমালোচনা। তিনি অধিকাংশ সময়ই মদ্যপান ও নারী আসক্তিতে থাকতেন।
যার কারনে শেষ পর্যন্ত বাংলায় সেন শাসনের পতন ঘটে।
বখতিয়ার খলজির বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা
নেতৃত্বহীনতা ও শাসকহীন সেন বংশ যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে তখন বাংলায় আসেন
দিল্লি বিজয়ী বীর মোহাম্মদ ঘুরির সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন
বখতিয়ার খলজি।
১২০৪ খ্রিস্টাব্দে লক্ষণ সেন যখন নদিয়ায় নারী নিয়ে আয়েশ করছেন, তখন নদীয়ার
সেই প্রাসাদটি ঘিরে ফেলে বখতিয়ার খলজির সেনারা। তখনো লক্ষণ সেন জানতেন না তার
রাজ্য দখল হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর যখন জানতে পারলেন তার রাজ্য দখল হয়ে
গিয়েছে, তখন তিনি নদীয়া ছেরে পলায়ন করলেন পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরে।
১২০৫ খ্রিস্টাব্দের লক্ষণ সেনের মৃত্যু হলে, স্বল্প সময়ে সেন বংশের রাজত্বের
অবসান ঘটে। এভাবে বাংলায় সৃষ্টি হয় মুসলিম শাসনের যুগ। তার আগে অবশ্য
মুসলমানরা উত্তর ভারতে আক্রমণ করে তা দখল করে নিয়েছিল।
মুসলমানদের অধীনে বাংলার সামাজিক অবস্থা
মুসলমানদের শাসনের অধীনে বাংলার জনগণের জীবনমান অনেক ক্ষেত্রে উন্নত হয়ে যায়।
নতুন নানা পেশায় নিয়োজিত হতে থাকে। যদিও কৃষিকাজ ছিল তাদের প্রধান পেশা।
এছাড়াও ক্ষুদ্র ও বৃহৎ ব্যবসায়ী শিল্পী, কারিগর, শ্রমিক, যোদ্ধা, তাতি,
সুতার,ও স্বর্ণকার সহ নানা পেশার লোক ছিল। এ সময় সাধারণ মানুষও শিক্ষার আলো
গ্রহণ করতে শুরু করে।
এর ফলে সমাজে উঁচু ও নিম্নমানের মানুষের জীবন যাপনের কোন পার্থক্য থাকে না।
অভিযাতরা সমাজের নিয়ন্ত্রক হিসেবে সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করতো। কিন্তু মুসলিম
শাসনের আওতায় আসার পর সবাই সমান সুযোগ পেয়ে যায়। যার কারণে সকল শ্রেণীর
মানুষ সমান অধিকার ভোগ করে।
প্রাচীন বাংলার নর-নারীর প্রধান পরিধেয় বস্ত্র ছিল ধুতি ও শাড়ি। মুসলিমরা আসার
পর বাংলার মানুষকে সভ্য করতে শিখিয়েছে। তারা শিখিয়েছে কিভাবে নিজের ইজ্জতকে
রক্ষা করতে হয়। সে সময় আর একটি বড় ব্যাধি ছিল বিধবা বিবাহ নিষেধ। তবে
মুসলমানরাও আসার পর এসব নীতি তুলে দেওয়া হয়। যার কারণে সমাজে ফিরে আসে সুস্থ
সমাজ নীতি।
মুসলমানদের অধীনে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা
মুসলমানরা বাংলায় আসার পূর্বে সাধারণ মানুষের পেশা ছিল কৃষি। তবে কৃষকেরা হিন্দু রাজাদের থেকে ফসলের বেশি দাম পেত না। যার কারণে বাংলায় অরাজকতা লেগেই থাকতো। কিন্তু মুসলিম শাসনের বিকাশ হওয়ার পর কৃষকরা তাদের ফসলের পূর্ণ দাম পায়।
যার ফলে বাংলার অর্থনীতি গড়গড় করে এগিয়ে যেতে থাকে। শুরু হয় শিল্প বিপ্লবের এক নতুন অধ্যায়। মানুষ বুঝতে পারে মুসলমানদের অধীনে বাংলা অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
মুসলমানদের অধীনে বাংলার হাট বাজার সুরক্ষিত ছিল। যার কারণে ডাকাতেরা অতর্কিত আক্রমণ করে হাট বাজারগুলো নষ্ট করতে পারত না। যার ফলে কৃষকের সুরক্ষা বহাল থাকতো। কৃষকের ফসলগুলো ভালো দাম দিয়ে কিনে নিয়ে মুসলমান বণিকেরা বাহিরে ব্যবসা করত। যার ফলে বাংলার অর্থনীতি সচ্ছল হতে থাকে। বাংলায় একপর্যায়ে হয়ে দাঁড়ায় সোনার খনি।
লেখকের মন্তব্য
আমরা বাঙালি মুসলমান। আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনেক সমৃদ্ধ। আমাদের পূর্বপুরুষ অর্থাৎ পূর্ববর্তী যেসব মুসলিম সেনাপতি ছিল তারা অল্প সৈন্য নিয়ে বিশাল বড় বড় যুদ্ধে জয়ী হয়েছে।
তার মাটি বড় প্রমাণ বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়। অল্প কিছু সাধারণ সৈন্য নিয়ে বাংলা বিজয় করেন তুর্কি এই সেনাপতি। বাংলায় তৈরি করেন ন্যায় শাসন।
যার কারণে তিনি হয়ে আছেন মুসলমানদের এক সমৃদ্ধ ইতিহাস। আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন নির্ভীক সাহসী ও যোদ্ধা প্রকৃতির। মুসলমানদের অধীনে বাংলা সে সময় হয়ে উঠেছিল বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র।
জোবায়ের ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়
comment url